1. admin@dainiksabujbangla.com : admin :
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
অভারের সংসারে বাবা হারা দুই মেয়ের স্বপ্ন পূরণে অটোরিকশা নিয়ে সড়কে বিধবা আলিফা ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত দৃষ্টিনন্দন স্পট বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত বাঁশখালীর প্রধান সড়কের টমটম অটোরিকশার হিড়িকে তীব্র যানজট তীব্র তাপদাহের মধ্যে লোডশেডিং সুপেয় পানি সংকটে বাঁশখালী উপকূলের মানুষ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পুকুরিয়া বাসীদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আলহাজ্ব মোঃ আসহাব উদ্দিন চেয়ারম্যান বাঁশখালীতে ঈদ উপহার বিতরণে অধ্যাপক নুরুল মোস্তফা সিকদার সংগ্রাম ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহীদুলের মৃত্যুতে শাহাজাহান চৌধুরীর শোক বাঁশখালীতে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন পাইপ জব্দ বাঁশখালীতে বাল্যবিবাহ নারী নির্যাতন কিশোর গ্যাং ও মাদক বিরোধী সমাবেশ বাঁশখালী চাঁদপুর বেলগাঁও চা বাগানে জেলা প্রশাসক

চট্টগ্রামের হাসির রাজা দিলীপ হোড়ের মুখে হাসি নেই – এস এস আবাদ

  • আপডেট সময় : রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২
  • ২৯১ বার পঠিত

বাংলাদেশের মধ্যে ভাষা ও কৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অন্যতম একটি জেলার নাম চট্টগ্রাম। মীরেরসরাই, সন্দ্বীপ আর সীতাকুণ্ডের কিছু অংশ ছাড়া অবশিষ্ট চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুখনিঃসৃত ভাষা (সামান্য পার্থক্য ছাড়া) প্রায় একই। সুতরাং বলা চলে এককোটি বা তারচেয়ে কয়েক লক্ষ বেশি লোকের নিত্যদিনের ব্যবহারের ভাষা এই চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষা। ভূমিকায় ভাষার কথা আসার কারণ অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেননা আমাদের প্রাণপ্রিয় আঞ্চলিক ভাষায় নাটক, মডেলিং ও মঞ্চাভিনয়ের মাধ্যমে কৌতুক পরিবেশন করে কিংবদন্তি হওয়া কৌতুক অভিনেতার পাশে এই কোটি জনতা যে একটি শক্তি হতে পারি তা স্বরণ করিয়ে দেয়া৷

চট্টগ্রামের অধিবাসীরা এতক্ষণে বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি। উপরের লেখাগুলি পড়তে পড়তেই সবার মনে যে নামটি স্বরণে এসেছে তা নিশ্চয়ই আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয়মুখ ‘মিডা চুন্ চুইন্না’ ওরফে ‘মেরা মিয়া’ খ্যাত ‘দিলীপ হোড়’।

দিলীপ হোড়ের পৈতৃক নিবাস ব্রিটিশ রাজত্বে কাঁপন ধরানো অগ্নিকন্যা প্রীতিলতার পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। জীবিকার তাগিদে তিনি চট্টগ্রাম শহরের নানা স্থান ঘুরে বর্তমানে দেওয়ান বাজার এলাকায় ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। কৈশোর বয়সেই তিনি পাড়া- মহল্লার নানান সামাজিক অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বনে লোক হাসাতেন।

আমার যতটুকু স্বরণে আসে, মেরা মিয়ার কন্ঠের সাথে আমার পরিচয় পঁচাশি/ ছিয়াশি সালের কাছাকাছি সময়ে। তখন চায়ের দোকানগুলোতে ৫৪৩ মডেলের বিখ্যাত টু-ইন-ওয়ানে ফিতার ক্যাসেটে ‘মিডা চুন্ চুইন্নার ফিরিতি” নামের নাটিকটি বাজতে শুনি। ব্যাপক জনপ্রিয় এই নাটকটি পরবর্তীতে ভিডিও সিডিতে পরিণত করা হলে সেটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কপট ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বিহীন মিড়া চুন্ চুইন্নার চরিত্রে দিলীপ হোড় এতটাই প্রাণবন্ত অভিনয় করেন যে, একসময় উনার আসল নাম হারিয়ে গিয়ে সবাই মিড়া চুন্ চুইন্না (অতিরিক্ত মিষ্টি) নামেই ডাকা শুরু করেন। নাটকে তার একটি সংলাপ ছিল এরকম, “অডি উয়াইশ্যা বলীর ঝি পেরতী, আইজো হণ্ডে দেইক্কছ মিডা চুন্ চুইন্নার কেরামতি।” ডায়লগ বলার ভঙ্গি এবং অনবদ্য অভিনয়ের কারনে কয়েক দশক পার হতে চললেও মানুষের অন্তরে এখনও তা গেঁথে আছে। নিজের আসল নাম হারিয়ে ফেলা এ নাটক ছাড়াও চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক নাটকে দিলীপ হোড় অভিনয় করেন।

আশি- নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি গানের কিংবদন্তি শিল্পী শেফালী ঘোষ ছিলেন দারুণ ব্যস্ত। উত্তর চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায় এবং পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে শেফালী ঘোষের গানের সাথে মজার মজার অঙ্গভঙ্গি ও কথামালায় মানুষের পেটে খিল ধরিয়ে দিতেন এই মিডা চিন্ চুইন্না। আমি নিজে এমনও দেখেছি বিয়ের মত পারিবারিক অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাই একান্তে উপভোগ করার জন্য দিলীপ হোড়কে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করা হতো। তবুও কিভাবে যেন এ-কান ও-কান হয়ে সারা গ্রামে জানাজানি হয়ে যেত এবং একপর্যায়ে মানুষের ঢল নেমে গেরস্ত বাড়ির-উঠোনের বাঁশের বেড়া ভেঙেচুরে এককার করে পারিবারিক একান্ত উপভোগের অনুষ্ঠান শেষপর্যন্ত গ্রামের সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হতো।

দিলীপ হোড় আপাদমস্তক রসিক মনের মানুষ। তাঁর কাছে অর্থকড়ির চেয়ে মানুষের ভালবাসাকেই বড় মনে হতো এবং এখনও তাই। পরিবারের নিকটজনেরা সময় থাকতে অন্যকোন স্থায়ী পেশায় মনোনিবেশ করার তাগাদা দিলেও দিলীপ হোড়ের মনকে মানুষ হাসানো হতে সরাতে পারেননি।
আজীবন সাদামাটা এই মানুষটি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তন্মধ্যে মহাশান্তি, চরম আঘাত, দরদী সন্তান, আশিক প্রিয়া ছিল ব্যবসা সফল। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক মঞ্চনাটক এবং বেশকিছু টেলিভিশন নাটকেও তিনি কৌতুক অভিনেতার ভুমিকায় অনবদ্য ছিলেন। এছাড়াও চা, লুঙ্গি ও শপিংমলের বিজ্ঞাপনেও মডেল হিসাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মডেলিংয়ে দিলীপ হোড় কে হিন্দি সিনেমার কিংবদন্তি দিলীপ কুমারের সমান জনপ্রিয় বললে অত্যুক্তি হবে না।
চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক গানের রাজা-রাণী খ্যাত শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব- আর শেফালী ঘোষের বিখ্যাত বেশ কিছু গান যেমনঃ (১) বাইক্কা টেয়া দে, (২) এক্কান হতা পুচার গইত্তাম মিছা ন হইঅ, (৩) আর বউরে আই মারির, (৪) হতা হইতাম ন’ আঁই মাইত্তাম ন’ (৫) ও ভাই বাস কন্টাকটার, এক্কান ছিড অইবো নি আঁর, (৬) বাজান গিইএ দইনর বিলত, পাড়ি বিছাইদি বইঅ ঘরত – ইত্যাদিতে দিলীপ হোড়ের মডেলিং এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে, তার অভিনয় দেখার জন্য মানুষ যাদের ঘরে ভিসিডি প্লেয়ার ছিল না তারা ভাড়া করে টিভি-ভিসিড়ি এনে শোনা গানগুলো আবার শোনার সাথে দিলীপ হোড়ের মডেলিং/অভিনয় দেখতো।

বৈষ্ণব-শেফালী পর চট্টগ্রামের আরেক জনপ্রিয় জুটি সঞ্জিত আচার্য- কল্যাণী ঘোষের গানেও দিলীপ হোড়-এর মডেলিং/অভিনয় ছিল দর্শক নন্দিত।
নব্বইয়ের ঘুর্ণিঝড়ের বেশ ক’বছর পর শিমুল শীল নামের নতুন একজন শিল্পী মাইজভাণ্ডারি গানের সুরে বাবা মোহছেন আউলিয়ার গান গেয়ে চট্টগ্রামে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। শিমুল শীল জনপ্রিয় হওয়ার আগে অনেকেই তাঁর মতো জুনিয়র শিল্পীর সাথে বাজনা বাজাতে কুন্ঠাবোধ করতেন। একবার তেমনি একটি গানের অনুষ্ঠানে শিমুল শীল কোন নামকরা বাদককে না পেয়ে গুরুজন দিলীপ হোড়কে মনোবেদনার কথা প্রকাশ করলেন। “রতনে রতন চিনে”- এ বাক্যকে সত্যে রুপান্তর করতে দিলীপ হোড় তার অনুজ প্রতিম শিমুল শীলকে অভয় দিয়ে বললেন,”তুই শুধু হারমোনিয়াম নিয়ে গান কর, মানুষ তোর গান পছন্দ করবে।” ঠিকই দিলীপ হোড়ের অভয়বাণী একসময় সত্যি হয়। আজ চট্টগ্রামের সেরা বাদকরা শিমুল শীলের সাথে বাজাতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে।

লেখাটি দীর্ঘ হয়ে গেলে আমার মত নীরস লেখকের লেখা পাঠের সময় এবং ধৈর্য সরস পাঠকের নাও হতে পারে। তাই দিলীপ হোড়ের মত মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণে শেষ টানতে গিয়ে আরেকজনের কথা অবশ্যই বলতে হচ্ছে। তিনি বর্তমান চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের অতুল্য সুরকার, গীতিকার ও গায়ক সিরাজুল ইসলাম আজাদ। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসা সফল হেডমাস্টার, চেয়ারম্যান সাব নামক ভিসিডিতে বেশকিছু গানেই ছোট ছোট কথামালায় সাজানো নানা-নাতি হিসেবে নিজে এবং দিলীপ হোড়কে নিয়ে অভিনয় করেন। দিলীপ হোড় থেকে মিডা চুন্ চুইন্না হয়ে যাওয়া নাম আবারও মেরা মিয়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে। মেরা মিয়ার ভূমিকায় (১) ও ডাক্তার সাব তোয়ারে জানাই, হ নারে ভাই আঁরে বুঝাই, (২) শুনরে সাধনের বৈদ্য, (৩) ও নাতিরে হইর তোরে, পীরিত ন’গরিচ, (৪) বিয়া মানি বন্দী অইযঅন, যতদিন বাঁচোচ (৫) মানা গজ্জিলাম তোরে ফিরিত ন’গরিচ ইত্যাদি গানে অভিনয় করেন। গানগুলো প্রকাশের পর একযুগেরও অধিককাল পেরিয়ে গেলেও এখনও চট্টগ্রামের মানুষ ইউটিউবে প্রতিনিয়ত দেখে অন্তরের গানসুধা মেঠায়।

এই অভিনয়প্রাণ মানুষটি আজ চরম অসুস্থ। সংসারে স্ত্রী ছাড়াও রয়েছে একছেলে এবং এক মেয়ে। ছেলেটি চাকুরী করতো তবে করোনাকালে চাকুরী চলে যাওয়ার পর এখন বেকার। মেয়েটি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দিলীপ হোড়ের দুর্দিনে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, শিল্পী ও সুধীজন যাঁরা জেনেছেন তাঁরা ইতিমধ্যে পাশে দাড়াবেন বলে জানিয়েছেন।

তবে দায়িত্ব শুধু তাঁদের কাঁধে ছেড়ে না দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোটি জনতা এক টাকা করে দিলেও দিলীপ হোড়ের সুচিকিৎসার সমস্যা হওয়া সম্ভব।
আসুন, “সাহায্য প্রদান না ভেবে তাঁর কাছ থেকে হাসির রসদ নেয়ার ঋণ পরিশোধ মনে করে” – যারা তার অভিনয় দেখে একবার হলেও হেসেছি তারা হাতে হাত মিলিয়ে চট্টগ্রামের হাসির রাজা দিলীপ হোড়-এর মুখের হাসি ফিরিয়ে দিই।

লেখক-ব্যাংকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর
© All rights reserved © 2022 Dainik Sabuj Bangla
Theme Customized By Shakil IT Park